Magic Lanthon

               

আসাদ লাবলু

প্রকাশিত ২৬ মার্চ ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

ইসরাইলের বেথেলহাম : আপেক্ষিকতার ‘অনিরপেক্ষ’ উপস্থাপন

আসাদ লাবলু


ক.

ফরাসি সমালোচক ও সাংবাদিক আলফোনেস কার-এর একটা বিখ্যাত উক্তি আছে। সেখানে তিনি ব্যক্তি চরিত্রের তিনটি রূপের কথা বলেছেন। প্রথমত, সত্যিকারার্থে ব্যক্তির একটা চরিত্র আছে। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তির নিজের কাছে নিজের একটা চরিত্র আছে। আর তৃতীয়ত, ওই ব্যক্তির একটা চরিত্র আছে অন্য সবার কাছে। এর বাইরেও ব্যক্তি চরিত্রের আরো নানা রূপ হয়তো বের করা যাবে। কিন্তু ব্যক্তির এই তিন চরিত্রের অস্তিত্বের সঙ্গে দ্বিমত করা যে কারো জন্যই কঠিন। একটু মাথা খাটালে বোঝা যায়, চরিত্রের দ্বিতীয় রূপটির সঙ্গে তৃতীয়টির বিশেষ একটা বিরোধ আছে। ব্যক্তি তার নিজের ধারণায় থাকা চরিত্রের রূপটিকে প্রায়ই নিজের সত্যিকারের চরিত্র বলে দাবি করে বসে। এক্ষেত্রে একই দাবি তোলে তৃতীয় রূপটিও, মানে অন্যরা। এই দ্বন্দ্বটা অনেকখানিই অনিবার্য। কেননা, ব্যক্তির আসল চরিত্রটা কী¾সেই রায় দেওয়ার মতো কোনো পক্ষই নেই। এই তিন পক্ষের বাইরে অনেকেই অনেককে মানেন বটে, কিন্তু সেখানেও ওই একই বিরোধ। তাই মনে হয়, কেবল মানুষের প্রকৃত চরিত্র খোঁজার ক্ষেত্রেই এই বিরোধ ক্রিয়াশীল নয়। প্রকৃত সত্য কী, প্রকৃত ন্যায় কী, প্রকৃত সুপথ কী, প্রকৃত বিচার কী¾তা খুঁজতে গিয়ে মানুষ শুরু থেকেই এই বিরোধের মধ্যে আছে এবং ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে। আর এই অন্বেষণে যতটুকু সত্য, যতটুকু সুপথ মিলেছে, ততটুকুই এখন পর্যন্ত মানুষের দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

ইসরাইল-ফিলিস্তিন নিয়ে একটা বিরোধ দীর্ঘদিন ধরে মানবসমাজকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে, এ কথা সবাই জানে। এবং এতে প্রকৃত সত্য প্রতিষ্ঠা করতে বিবাদমান পক্ষগুলোর কাছে স্ব স্ব যুক্তি আছে। আর বিতর্কের শুরু থেকেই তারা এসব যুক্তি গলা ফাটিয়ে বলে আসছেন। যেমন এই তর্কে এখনকার মতো আগেও

প্রথম প্রশ্ন এই উঠিত, সে দেশটা কাহার। ইহুদিরা বলিত, এই পবিত্র দেশ আমাদের পিতৃভূমি, মূসা (মোজেস) আমাদিগকে এই দেশের পথ দেখাইয়া আনেন; আমাদের গর্বস্থল রাজা সুলেমন (সলমন), দায়ুদ (ডেভিড) এই দেশে রাজত্ব করিয়াছেন, আমাদের প্রপিতামহ ইব্রাহিমের (আব্রাহামের) কবর এই মাটিতে। এই দেশ আমাদের পুণ্যভূমি, এখন এই দেশকে আমাদের কর্মভূমিতে পরিণত করতে চাহি। (সত্যেন দত্তের তীর্থসলিলে রাজা সুলেমন ও দায়ুদের গীতি দ্রষ্টব্য)। উত্তরে আরব বলে তোমাদের মত আমরাও সেমিটি, যে সব মহাপুরুষদের নাম করিলে তাঁহারা আমাদেরও পূর্বপুরুষ। তাঁহাদের গোর আমাদের তীর্থস্থল-দরগাহ। ইহাদের মহৎ কার্যকলাপ কুরআনে বর্ণিত হইয়াছে। উপরন্তু জেরুজালেম (বয়ত উল-মুকদ্দ পবিত্রালয়) আমাদের কাছে মক্কার পরেই সম্মানিত। কিন্তু এসব ধর্ম-সম্বন্ধনীয় হার্দিক আলোচনা উপস্থিত স্থগিত রাখো। আসল কথাটা এই তোমাদের স্বাধীনতা লোপ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই (খৃষ্টের বহুপূর্বে) তোমরা এই দেশ ত্যাগ করিতে আরম্ভ করো, খৃষ্টের পর তোমাদের অধিকাংশ জাতভাই খৃষ্টান হইয়া যায়¾তাহারা আজ আমাদের দলে, পরবর্তী যুগে তাহাদিগের অধিকাংশ আবার মুসলমান হইয়া যায়¾এবং সর্বশেষ ক্রুসেডের আমলে যখন যুদ্ধ, অরাজকতা ও অনাসৃষ্টির ফলে দেশটা উচ্ছনে গেল, তখন তোমরা সকলেই পোড়া দেশকে ছাড়িয়া কারবারে পয়সা করিবার জন্য পৃথিবীর সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িলে। আমরা এই দেশের মাটিকে ভালোবাসিতাম¾সেই মাটিকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া আটশত বৎসর কাটাইলাম, এখন পয়সার জোর হইয়াছে বলিয়া আমাদিগকে ভিটা-ছাড়া করিতে চাও? তোমাদের বেশ ভূষা বিজাতীয়, তোমাদের আচার-ব্যবহার এদেশের প্রাচীন ইহুদী পন্থানুযায়ী নহে (অর্থাৎ যে কয়টি ইহুদি দুর্দিনে এদেশ ত্যাগ করিয়া যায় নাই তাঁহাদের আচার ব্যবহারের সঙ্গে আমাদের আজ মিল বেশী), তোমরা বার্লিন প্যারিসের নৈতিক চরিত্র ও দুষ্ট রোগ সঙ্গে আনিয়াছ, আর সর্বশেষ কথা, আমাদের দুশমন ইংরাজ সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে তোমরা বন্ধুত্ব করিয়াছ।

প্রায় শখানেক বছর ধরে এই বিবাদ চললেও একবিংশ শতাব্দীতে এসে এর রূপ খুব একটা হেরফের হয়েছে বলে মনে হয় না। আজও স্ব স্ব যুক্তির গাঁথুনিতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন ইট। সেই ইটের যোগানদারদের তালিকায় নাম আছে চলচ্চিত্রেরও। প্রমাণ ইসরাইলি চলচ্চিত্র বেথেলহাম (২০১৩)। কীভাবে¾সেই আলোচনাই এখানে একে একে করার চেষ্টা থাকবে। এক্ষেত্রে চলচ্চিত্রটির মূল কাহিনি ও সংশ্লিষ্ট কিছু তথ্য জেনে নেওয়া দরকার।

খ.

প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক বেথেলহাম শহর সম্পর্কে। পশ্চিমতীরের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত এ শহর থেকে জেরুজালেমের অবস্থান মাইল ছয়েক দক্ষিণে। বেথেলহামের দখল-পুনর্দখলের ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে অন্তত খ্রিস্টের জন্ম তারিখ পর্যন্ত ফিরে যেতে হবে। আর ঘাঁটাঘাঁটি করে যা পাওয়া যাবে, তা নিয়ে শেষমেষ ওই একই প্রশ্ন উঠিবে, শহরটা আসলে কার? তাই সেদিকে না যাওয়াই ভালো। বরং সেখানকার সাম্প্রতিক কিছু টুকিটাকি তথ্য পরবর্তী আলোচনার ক্ষেত্রে পাঠকদের কাজে লাগতে পারে। যুদ্ধের মাধ্যমে বেথেলহাম শহরটির দখলদারিত্বে সর্বশেষ পরিবর্তন ঘটে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে। ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরাইল সেটি দখল করে নেয়। এরপর সেখান থেকে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় ইসরাইলি সেনা। তখন থেকে এখন পর্যন্ত শহরটি ইন্টারিম অ্যাগ্রিমেন্ট অন দ্য ওয়েস্ট ব্যাংক অ্যান্ড দ্য গাজা স্ট্রিপ’ চুক্তির অধীনে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অধীনে আছে। কিন্তু এ কেবল কাগজে-কলমে। সেখানে ইসরাইলি নজরদারি কিংবা দখলদারিত্ব এতটুকু কমেনি।

দ্বিতীয় ফিলিস্তিনি ইনতিফাদার (২০০০-২০০৫) সময় বেথেলহামের অধিকাংশ স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয় ইসরাইলি বাহিনী। বিশেষ করে সেখানকার পর্যটনশিল্পকে। এখানে বলে রাখা দরকার যে, এখনো শহরটির বেশিরভাগ মানুষ পর্যটনশিল্পের ওপর নির্ভরশীল। দ্বিতীয় ইনতিফাদা ছাড়াও আরেকবার ইসরাইলি হামলার শিকার হয় বেথেলহামের মুসলমানরা। সেটি ২০০২ খ্রিস্টাব্দে ইসরাইলি বাহিনীর ‘অপারেশন ডিফেনসিভ শিল্ড’-এর সময়। এসব আগ্রাসনের প্রভাব কতোটা পড়েছে তার একটা আঁচ পাওয়া যায়, প্যালেস্টানিয়ান সেন্ট্রাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস-এর (পি সি বি এস) এক সমীক্ষায়। ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ওই সমীক্ষা অনুযায়ী, বেথেলহামের মুসলমান শরণার্থীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার পাঁচশো ৭০ জনে; যা সেখানকার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ। এই হলো ফিলিস্তিনের বেথেলহাম।

এবার দেখবো নির্মাতা ইয়োভাল অ্যাডলার-এর বেথেলহাম। তার আগে দু-চার লাইনে নির্মাতার পরিচয়টা জানিয়ে রাখছি। ইয়োভালের বেড়ে ওঠা ইসরাইলেই। তেল আবিব ইউনিভার্সিটিতে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ইয়োভাল দর্শনে পিএইচ ডি করেন। এছাড়া ভাস্কর্যবিদ্যা ও ফটোগ্রাফি নিয়েও পড়াশোনা আছে তার।

চলচ্চিত্রজগতে ইয়োভালের প্রথম কাজ বেথেলহাম। প্রথম হিসেবে ‘সফলতা’ও খারাপ নয়। সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র হিসেবে ৮৬তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে স্থান পেয়েছিলো বেথেলহাম। ছয়টি ‘অফির অ্যাওয়ার্ড’সহ পেয়েছে ইসরাইলের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও। চলচ্চিত্রের অভিষেক নির্মাতা হিসেবে আরেকটি কাজের জন্য প্রশংসার দাবিদার ইয়োভাল। এই চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করিয়েছেন অপেশাদার ব্যক্তিদের দিয়ে। বিশেষ করে প্রধান তিন চরিত্র¾সানফুর (সাদি মারি), রাজি (সাহি হ্যালেভি) ও বাদায়ি (হিথাম ওমারি) এর আগে কখনোই অভিনয় করেননি। কিন্তু তাদের কাজে সেটি মোটামুটি অধরাই থেকে গেছে।

এবার বেথেলহাম-এর কাহিনি বলছি সংক্ষেপে। ইব্রাহিমের ছোটো ভাই সানফুর। ইব্রাহিম ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন ‘আল-আকসা ব্রিগেড’-এর শীর্ষস্থানীয় সদস্য। ইসরাইলি গোয়েন্দাদের কাছে তিনি মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গিদের (মূলধারার গণমাধ্যমে মিলিট্যান্ট, সেই হিসেবে জঙ্গি) একজন। অন্যদিকে রাজি, ইসরাইলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা। সানফুরের সঙ্গে রাজির সম্পর্ক গুপ্তচর ও গোয়েন্দার। তবে তারা দুজন খুবই ঘনিষ্ঠ। এই ঘনিষ্ঠতা পেশাগত সম্পর্ককে ছাড়িয়ে মানবিক সম্পর্কে প্রোথিত। কিন্তু নিজের ভাই ইব্রাহিমের আদর্শ দ্বারাও প্রভাবিত সানফুর। আবার রাজির সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্কের দায়বদ্ধতাও আছে তার মধ্যে।

একইভাবে কর্মক্ষেত্র ও সানফুর¾দুই-ই ঠিক রাখতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন রাজি। এ রকম একটা সম্পর্কের মধ্যে নানান আনুষঙ্গিক ঘটনার প্রবেশ-প্রস্থানের মধ্য দিয়ে এগোতে থাকে কাহিনি। এরই মধ্যে ইসরাইলিদের ওপর আরেকটি বোমা হামলার দায় স্বীকার করেন ইব্রাহিম। শেষ দিকে ইসরাইলি গোয়েন্দারা তথ্য পায়, এক ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নিতে স্থানীয় বাজারে আসবেন ইব্রাহিম। পরিকল্পনা হয় টাকা নেওয়ার সময়ই তাকে মেরে ফেলা হবে। কিন্তু রাজি জানতে পারেন, যে লোক টাকাটা দিতে যাবে, সে সানফুর। এতে চিন্তায় পড়ে যান রাজি। কারণ, ওই অভিযানে সানফুরও মারা যেতে পারেন।

তাই সানফুরকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। এমনকি রাজি এ নিয়ে তার ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তর্কও করেন। এসবের কিছুই জানেন না সানফুর। শেষ পর্যন্ত ঘটনার আগে রাজি কৌশলে সানফুরকে তার এক আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। ওই অবস্থায় আরেকজনকে দিয়ে ইব্রাহিমের কাছে টাকা পাঠায় আল-আকসা ব্রিগেডের সদস্যরা। আর ওই টাকা নেওয়ার সময় ইসরাইলি বাহিনীর অভিযানে নিহত হন ইব্রাহিম। এই খবর যায় সানফুরের কাছে। কিন্তু একই সময় আল-আকসার সদস্যরা জেনে ফেলে সানফুর একজন ইসরাইলি গুপ্তচর। এ অবস্থায় তারা সানফুরকে শর্ত দেয়, হয় তাকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র জন্য মরতে হবে, নয়তো ‘দেশপ্রেমিক’ হিসেবে রাজিকে হত্যা করার দায়িত্ব নিতে হবে। শেষে ‘দেশপ্রেমিক’ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সানফুর। মিথ্যা কথা বলে মোবাইলফোনে তিনি রাজিকে ডেকে নেন এবং হত্যা করেন। আর এটিই বেথেলহামে বানানো বেথেলহাম-এর শেষ দৃশ্য।

গ.

এই চলচ্চিত্রে রাজি ও সানফুরের সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলার দিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন ইয়োভাল। এক্ষেত্রে তার ভাষ্য, কোনো কল্পনার জায়গা থেকে তিনি এই সম্পর্কের আবির্ভাব ঘটাননি। ‘আমরা কয়েকজন সাবেক গুপ্তচর ও গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের সঙ্গে কথা বলে আমরা বেশ অবাকই হয়েছি, তাদের মধ্যে এই সম্পর্ক কতোটা মানবিক!’ এবং সেখান থেকে উৎসাহিত হয়েই এমন একটা বিষয়কে নিয়ে বেথেলহাম নির্মাণ করেন ইয়োভাল।

এখন কথা হলো, গোয়েন্দা ও গুপ্তচরের সম্পর্কের মধ্যে প্রকট মানবিক টানের প্রকাশ থাকতেই পারে। কিন্তু এও ঠিক যে, এ রকমের প্রতিটি সম্পর্র্কের ক্ষেত্রেই এমন ঘনিষ্ঠতা থাকবে না, থাকে না। সেই ক্ষেত্রে সানফুর-রাজির বিষয়টিকে ইয়োভাল সর্বজনীন অর্থে প্রয়োগ করেছেন কি না, সেই রায় দিতে চাইছি না। বরং এ নিয়ে তিনি যা বলেছেন, তা পাঠকের জন্য তুলে ধরাই সমীচীন। ‘আমি বরাবরই ঘটনার পিছনের ঘটনার দিকে বেশি আগ্রহী। দেখতে চাই প্রকৃত ঘটনা কী। বাইরে থেকে যেটা দেখা যায়, সেটার দিকে আমার তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই।’ ইয়োভালের এ বক্তব্যের পরও ধরে নিলাম, গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও গুপ্তচরের মধ্যে এটা একটা ব্যতিক্রমী সম্পর্ক। কিন্তু এই ব্যতিক্রমের সঙ্গে পারিপার্শ্বিক স্বাভাবিকতার মিশ্রণ ঘটিয়ে কিছু অস্বাভাবিকতা তৈরি করেছেন তিনি। সেটা কী রকম¾

রাজি ও সানফুরের ঘনিষ্ঠতার গভীরতা বোঝাতে এখানে কয়েকটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা জরুরি। জিদের বশে একটি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে সানফুর প্রতিবেশী জামালকে বলেন তাকে গুলি করতে। সেই গুলি জ্যাকেট ভেদ করে সানফুরের পেটে বিদ্ধ হয়। গুলি খেয়ে রাজির শরণাপন্ন হন সানফুর। রাজি তাকে একটি ইসরাইলি হাসপাতালে ভর্তি করে সারিয়ে তোলেন।

একটা নির্জন জায়গায় প্রায় গায়ে-গা লাগিয়ে চুপচাপ বসে আছেন রাজি ও সানফুর। নীরবতা ভাঙতে প্রথমে রাজি কনুই দিয়ে সানফুরকে গুঁতা দেন। সানফুরও একটু পর একই খুনসুটি করেন। মৌনতা ভেঙে সানফুর বলেন, আমাকে জিন্স প্যান্ট কিনে দিবে না?

রাজি : তুমি তার যোগ্য নও।

সানফুর : কিন্তু তুমি তো কথা দিয়েছিলে কিনে দিবে।

রাজি : আচ্ছা তোমার কথাই হবে, কিনে দিবো।

এরপরের দৃশ্যেই দেখা যায়, রাজি অনেকটা চুপ করে সানফুরকে টাকা দিচ্ছেন। একই সঙ্গে সানফুরকে তার আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ঘুরে আসতেও বলছেন। কারণ, সানফুরকে বাঁচাতে চান রাজি। পুরো চলচ্চিত্রে এ রকম আরো কয়েকটি ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত আছে তাদের দুজনের। এমনকি রাজি একা থাকলেও সানফুরকে নিয়ে কতোটা চিন্তা করেন, তা স্পষ্টই টের পাওয়া যায়।

এখানে দুজনের সম্পর্কের যে ঘনিষ্ঠতা তা একদম রেডিমেড। তাই এই সম্পর্ক কীভাবে গড়ে উঠেছে, তা দর্শক ঠাওর করতে পারেনি। আর এ কারণেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, সানফুর কি স্বেচ্ছায় গুপ্তচর হয়েছেন, নাকি বাধ্য হয়ে। সাধারণ চিন্তায় এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বাধ্য করেই তাকে গুপ্তচর বানানো হয়েছে। কেননা, ইব্রাহিমের আদর্শ দ্বারা সানফুর ব্যাপক অনুপ্রাণিত, প্রভাবিত। তাই এ রকম দেশপ্রেম নিয়ে কারো পক্ষে স্বেচ্ছায় শত্রুপক্ষের গুপ্তচর হওয়ার কথা নয়। এই অবস্থায় এসে আবার সম্পূরক প্রশ্ন জাগে, এতো মানবিক গুণাবলি সম্পন্ন রাজি কীভাবে সানফুরকে বশে আনলেন?

এখানে আরেকটা বিষয় চোখে পড়ার মতো। সেটা হলো, এই সম্পর্কে পারস্পরিক আকর্ষণের অনুপাতে সানফুরের চেয়ে রাজির পাল্লাই ভারী। কারণ, পুরো চলচ্চিত্রে সানফুরকে একবারও দেখা যায় না রাজির আকর্ষণে তাকে ডাকতে। বরং যখন নিজের স্বার্থগত প্রয়োজন পড়েছে, তখনই কেবল তিনি স্মরণ করেছেন রাজিকে। এর মধ্যে শেষবার তো রাজির জীবন নিয়েই নিজের স্বার্থ হাসিল করেন তিনি। তাই এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, গুপ্তচরের সঙ্গে গোয়েন্দা কর্মকর্তার মানবিক সম্পর্ক ফিলিস্তিনের বেথেলহামে সম্ভব হলেও ইয়োভালের বেথেলহাম-এ তার যথাযথ প্রতিফলন ঘটেনি।

ঘ.

আলোচনার একদম শুরুতে কার-এর উদ্ধৃতি দিয়ে ব্যক্তি চরিত্রের তিন ধরনের রূপের কথা বলেছিলাম। সেই আলোচনাকে এখানে আরো প্রাসঙ্গিক করে তোলার সুযোগ রয়েছে। বেথেলহাম-এ সাধারণ ফিলিস্তিনি নেই বললেই চলে। যে একজন আছেন, তিনি সানফুরের বাবা। কিন্তু তিনিও ইব্রাহিম, আল-আকসা কিংবা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রায় প্রত্যক্ষভাবেই জড়িত। সবমিলিয়ে চলচ্চিত্রে যতগুলো ফিলিস্তিনি চরিত্র দেখা যায়, তাদের সবাইকে উপস্থাপন করা হয়েছে স্বার্থপর হিসেবে। এমনকি যে ইব্রাহিমকে নিয়ে ফিলিস্তিনিরা গর্ব করে, নৈতিকতার বিচারে তিনিও চলচ্চিত্রে বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নাকি আল-আকসার সদস্য হয়েও অর্থের বিনিময়ে গোপনে হামাসের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।

ইব্রাহিমকে হত্যা করতে ইসরাইলি বাহিনীর অভিযানের দিকে নজর দিলেও, এ নিয়ে আরো বাড়তি দু-চার লাইন বলা যেতে পারে। সেখানেও রাতের বেলা অভিযান চলাকালে স্থানীয় ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলি বাহিনীর ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপসহ ব্যাপকভাবে চড়াও হয়। ভাঙচুর চালায় তাদের একাধিক গাড়িতে। কিন্তু এর মধ্যেও কেবল আত্মরক্ষা ছাড়া ইসরাইলি সেনাদের তেমন কোনো আগ্রাসী মনোভাব চোখে পড়ে না চলচ্চিত্রে। অথচ, বাস্তবে প্রায়ই পশ্চিমা গণমাধ্যমে দেখা যায়, দিনের বেলায় কারো হত্যার বিচার চেয়ে একটা স্লোগান দিলেও ফিলিস্তিনিদের ওপর ব্যাপকমাত্রায় চড়াও হয় ইসরাইলি সেনারা।

এবার বেথেলহাম-এর নানা চরিত্রের প্রতিনিধিত্বের বিচারে আসি। এই চলচ্চিত্রে ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইসরাইলের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের একমাত্র প্রতীক সানফুর-রাজির সম্পর্ক। যেখানে রাজি যতটা না গোয়েন্দা, তার চেয়েও বেশি বন্ধু। এমনকি অভিভাবকও বলা চলে। অর্থাৎ, পুরোটাই নিরেট ভালোবাসা। অন্যদিকে সানফুরের চরিত্রে স্বার্থপরতার ছাপ কিন্তু স্পষ্ট। এবং রাজিকে হত্যার বিষয়টি শেষমেষ পুরোই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হিসেবে প্রতীয়মান। তার মানে ফিলিস্তিনিদের আসল চরিত্র কী¾তা এই চলচ্চিত্রে আগাগোড়াতেই অন্যদের অর্থাৎ ইসরাইলি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখানো। এখানে সত্যিকার চরিত্রের বিচার তর্কে বহুদূর, তা জানি। কিন্তু চলচ্চিত্রে এই তর্কের ফল যে সবসময় ইসরাইলের দিকেই যাবে; তা-ই হয়তো ইয়োভালের সার্থকতা।

ঙ.

পৃথিবীতে যেকোনো বিপ্লব, স্বাধীনতা কিংবা দাবি আদায়ের আন্দোলনে মতবিরোধ স্বাভাবিক ব্যাপার। সুতরাং, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামীদের নেতৃত্ব প্রদানকারী সংগঠনগুলোর মধ্যে এই বিরোধ থাকতেই পারে। বরং না থাকাটাই অস্বাভাবিক। পথ এক হলেও মত ভিন্ন। এটাই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সৌন্দর্য। বেথেলহাম-এ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আল-আকসা ব্রিগেডের যে বৈরিতা ইয়োভাল তুলে ধরেছেন, তার বাস্তব অস্তিত্ব আছে। আবার সানফুরের মতো বোঝাপড়াহীন উত্তেজনা কিংবা দেশপ্রেম, ইব্রাহিমের মতো ‘ভুল’ পথে আন্দোলন¾এসবও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আছে। কিন্তু প্রকাশের ধরন ভুল বলে, প্রকাশের বাহ্যিকতা জটিল বলে তো আর ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার বাসনা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে না!

কেউ হয়তো ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনের জন্য দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধানের কথা বলছে। আবার কেউ হয়তো বলছে, একই রাষ্ট্রের মধ্যে সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে থাকার কথা। কিন্তু মোদ্দা কথায় গিয়ে তো আর এ পার্থক্য থাকে না। কারণ, দুই রাষ্ট্র কিংবা এক রাষ্ট্র নয়, অধিকাংশ ফিলিস্তিনি এখন মুক্ত-স্বাধীনভাবে নিজেদের জীবন কাটাতে চায়। বেথেলহাম-এ এই চাওয়ার প্রতিফলন নেই! বাহ্যিক জটিলতার উপস্থাপনের বাড়াবাড়িতে হারিয়ে গেছে বুকের গহিনের বাসনা। আর এতে করে যেটা হয়েছে, দৃশ্যত কিছু অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখিয়ে আড়াল করা হয়েছে ফিলিস্তিনিদের মূল যে চাওয়া, স্বাধীনতার বিষয়টিকে।

বেথেলহাম-এর সব ফিলিস্তিনি চরিত্রকেই উদ্দেশ্যহীন মনে হয়েছে। কোনো চরিত্রের মধ্যেই স্পষ্ট কোনো বক্তব্য নেই। চলচ্চিত্রে ফিলিস্তিনিদের কাছে সবচেয়ে অনুকরণীয় চরিত্র ইব্রাহিম। অথচ তিনি পলাতক। আল-আকসা ব্রিগেডের নেতা বাদাওয়ি’র সঙ্গে মোবাইলফোনে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আমি কুকুরের মতো জীবন পার করছি।’ এই হলো ফিলিস্তিনের সবচেয়ে বড়ো বীরের অবস্থা! আর এই বীরের প্রধান লক্ষ্যই হলো, বোমা হামলা চালিয়ে ইসরাইলিদের হত্যা করা। কিন্তু কেনো এই পালিয়ে থাকা, কেনো এই গুপ্ত হামলা¾এসবের কোনো ব্যাখ্যাই নেই ইয়োভালের বেথেলহাম-এ। নাকি নির্মাতা বলতে চেয়েছেন, ফিলিস্তিনিদের আসলে গুছিয়ে বলার কিছুই নেই? নাকি বলার থাকলেও অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে প্রকাশের সময় এখনো অনেক দূর!

চ.

‘হারিজ’ সাময়িকীতে এক সাক্ষাৎকারে ইয়োভাল দাবি করেছেন, তার এ চলচ্চিত্রটি রাজনৈতিক কোনো চলচ্চিত্র নয়। বেথেলহাম নিয়ে ইয়োভালের এই মূল্যায়ন হাস্যকর। কারণ, ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার কোনো বিষয়কে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার উপায় নেই। এই চলচ্চিত্রে তিনি স্পষ্টতই রাজি ও সানফুরের মানবিক সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করেছেন, তাতে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু পারস্পরিক এই সম্পর্কের মধ্যে কি তিনি রাজনীতির ঘাত-প্রতিঘাত ছাড়া আর কিছু দেখাতে পেরেছেন? এই দুই চরিত্রের মধ্যে যে মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েন, তা থেকে ইসরাইল-ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক নির্যাসটুকু বের করে নিলে, সেই সম্পর্কের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।

আলোচনার শেষে বেথেলহাম-এর শেষ নিয়ে একটু কথা বলতে চাই। শেষটা কী, তা আগেই বলেছি¾সানফুরের গুলিতে রাজির মৃত্যু। এমন একটা করুণ পরিণতির মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সঙ্কট নিয়ে কোনো আশার আলো দেখা যায় কি? ইয়োভাল বলেছেন, ‘হ্যাঁ।’ কিন্তু তিনি ঠিক কোন দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আশার আলো দেখেছেন তা বোধগম্য নয়। তিনি কি মানবিকতা দিয়ে আশার আলো দেখেছেন? কিন্তু সেটার তো শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হলো। নাকি সানফুরের ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ শান্তি এনে দিবে। যদি তাই হয়, তাহলে সানফুরের বিশেষণ পাল্টিয়ে ‘দেশপ্রেমিক’ করতে হতে পারে।

আবার যদি ইয়োভাল এও বুঝিয়ে থাকেন যে, এভাবে চলতে থাকলে একদিন ইসরাইলি গোয়েন্দা রাজির মানবিকতাই জয়ী হবে; সেক্ষেত্রেও বিপত্তি আছে। তখন প্রশ্ন উঠবে, রাজি আর সানফুর কি তাহলে একসঙ্গে এক রাষ্ট্রেই থাকবে; নাকি দুই রাষ্ট্রে আলাদা-আলাদা থাকবে? একসঙ্গে থাকলে কি ইসরাইলিদের আনুগত্য নিয়েই থাকতে হবে, নাকি সানফুর নিজের মতো করে থাকতে পারবে? আর আলাদা-আলাদা রাষ্ট্রে থাকলে সানফুরদের দেশ কোথায় হবে? কারণ, যেভাবে ইসরাইলি দখলদারিত্ব চলছে তাতে নোম চমস্কির মন্তব্যের মতোও কিছু একটা ঘটতে পারে¾জর্জ বুশের স্বপ্নগুলোর মধ্যে একটির কথা আমি বলতে পারি। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, কোনো এক জায়গায়। কোনো নাম না জানা জায়গায়, হতে পারে সেটা সৌদি আরবের মরুভূমিতে।’

লেখক : আসাদ লাবলু, দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় শিক্ষানবিশ সহ-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত।

asadmcru@gmail.com

তথ্যসূত্র

১. আলী, সৈয়দ মুজতবা (১৪১১ বঙ্গাব্দ : ২৯৩); ‘প্যালেস্টাইন’; সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী; সপ্তম খণ্ডের প্রথম পর্ব, স্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা।

২. https://www.haarety.com/opinion/.premium-1.550699

৩. চমস্কি, নোম (২০১০ : ১৮); সাম্রাজ্যিক বাসনা; অনুবাদ : প্রতীক বর্ধন; সংহতি প্রকাশন, ঢাকা।

 



বি. দ্র. প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ম্যাজিক লণ্ঠনের ৯ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়।




এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন